ডিজিটাল পদ্ধতি অবলম্বন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষ স্নাতক সম্মান শ্রেণীর ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে একটি জালিয়াত চক্র। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁসের পুরো প্রক্রিয়ায় সঙ্গে জড়িত আছেন বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের কতিপয় শিক্ষক, কমকর্তা-কর্মচারী এবং ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। মোবাইল ফোনে কথা বলা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইমো, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে তথ্য বিনিময় এবং ক্ষুদেবার্তা আদান-প্রদান করেছে ওই চক্রের সদস্যরা।
অনুসন্ধান ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আটক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের দেয়া বর্ণনায় পাওয়া গেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। তবে এ ঘটনায় ভর্তিচ্ছু কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হলেও রহস্যজনক কারণে বাকিরা অধরাই থাকছে।
শুক্রবার ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় আটক সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই ইমো, ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে উত্তরসহ প্রশ্নপত্র পেয়েছে। বাকি দু’জন ডিজিটাল ডিভাইস তাদের কানে স্থাপন করে পরীক্ষার হলে ঢুকেছে। এর আগে বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে আটক ১৩ শিক্ষার্থীও ইন্টারনেটের মাধ্যমে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিল।
এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করতে পরীক্ষার শুরু থেকেই মরিয়া হয়ে ওঠে জালিয়াত চক্র। তবে কলা অনুষদভুক্ত ‘খ’ ইউনিট ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত ‘গ’ ইউনিটের পরীক্ষায় তারা ততটা সফল হতে পারেনি। কারণ এবারের প্রশ্নপত্রে কোনো সেট কোড ছিল না। এতে কোনো শিক্ষার্থী তার সেট কোড বাইরে পাঠাতে পারত না। ফলে বাইরে থাকা চক্রের সদস্যরা এটি বুঝত না যে, তারা কোন কোডটি পেয়েছে। তবে সব সেটেই যেহেতু একই প্রশ্ন থাকে, শুধু প্রশ্নক্রমটি এলোমেলো করে দেয়া হয়- তাই তারা প্রশ্ন ফাঁসের দিকে অধিক মনযোগ দেয়। এতে তারা সফলও হয়।
‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস মহামারী আকার ধারণ করে। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসের ৫৪টি ও ক্যাম্পাসের বাইরের ৪৫টি স্কুল-কলেজসহ মোট ৯৯টি কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শুরুর নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ফাঁস হয় প্রশ্ন। সকাল ১০টার পূর্বেই ইন্টারনেটে প্রশ্ন এবং এর উত্তর আসার বেশ কিছু রেকর্ড যুগান্তরের হাতে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ৯টা ৩৭ থেকে ৩৮ মিনিটের মধ্যে একটি অ্যাপসে প্রশ্নের উত্তর আসতে শুরু করেছে। ৯টা ৪৯ মিনিট থেকে ৫০ মিনিটের মধ্যে সমাধানসহ প্রশ্নের উত্তর এসেছে। যেহেতু প্রশ্নটি সমাধান করতেও সময় লেগেছে, তাই ধারণা করা হচ্ছে- ৯টার মধ্যেই জালিয়াত চক্রের হাতে প্রশ্নের কপি চলে গেছে। অন্যদিকে একই প্রশ্নের ছবি চক্রটি একাধিকবার পাঠিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, একাধিক ব্যক্তিকে প্রশ্ন পাঠাতে গিয়ে ভুলে এমনটি হয়েছে।
ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন এবং সংরক্ষণের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এম আমজাদ আলী যুগান্তরকে বলেন, প্রশ্ন প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের একাধিক ‘এক্সপার্ট’দের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রশ্ন আহ্বান করা হয়। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট অনুষদের মডারেশন বোর্ড অপশনসহ উত্তর সেট করে। সেই প্রশ্নটি চলে যায় ডিনকে প্রধান করে গঠিত ৩-৪ সদস্য বিশিষ্ট কোর কমিটির কাছে। পরে সেটি ছাপাতে দেয়া হয়। যারা প্রশ্ন ছাপবেন- ছাপানোর পূর্বে তারাও জানেন না যে প্রশ্নটি ছাপা হচ্ছে। ছাপখানাতেই প্রশ্নটি সিলগালা করে ফেলা হয়। সেখান থেকে প্রশ্নটি এনে ডিন অফিস কিংবা কন্ট্রোলার অফিসে রাখা হয়। পরীক্ষার দিন সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে প্রশ্নটি কেন্দ্রে চলে যায়। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পূর্বে সেটি পরীক্ষার কক্ষে পৌঁছে। ২ মিনিট পূর্বে প্রশ্নটি শিক্ষার্থীদের হাতে যায়।
প্রশ্ন প্রণয়ন ও সরবরাহের এ প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাড়ে ৯টার দিকে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্ন যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর আগে প্রশ্ন থাকে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র প্রধানের কাছে। ধারণা করা হচ্ছে, কোনো একটি বা একাধিক কেন্দ্রের প্রধান এ কুকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর বলেন, আমরাও ধারণা করছি কোনো একটি কেন্দ্র প্রধান প্রশ্ন বাইরে সরবরাহে কাজ করছেন। তা না হলে কোনোভাবেই প্রশ্ন বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কেন্দ্রগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পৌঁছাতে দেরি হওয়ার সুযোগে তারা এ কাজটি করে থাকতে পারেন বলেও মনে করেন তিনি।
অধরা মূল হোতারা : ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির দায়ে এ বছর ২০ শিক্ষার্থী আটক হলেও চক্রের মূলহোতারা আটক হয়নি। প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় একই চিত্র দেখা যায়। বিগত বছরগুলোয় আটক শিক্ষার্থীরা মূলহোতাদের সম্পর্কে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেও পরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে তেমন একটা অগ্রগতি দেখা যায়নি। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের যেসব নেতার বিরুদ্ধে এ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে, তারাও খুব একটা শাস্তির আওতায় আসেনি। অনেক সময় দু’একজন গ্রেফতার হলেও কিছুদিন বাদেই জামিনে বেরিয়ে এসে জড়িয়ে পড়েছে একই কাজে। এছাড়া বিভিন্ন সময় যারা আটক হয়েছে তাদের থেকেও খুব একটা তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি প্রশাসন। ফলে চক্রের মূলহোতারা বরাবরই থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দায়িত্বে অবহেলা : বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী মোবাইল ফোন কিংবা ইলেকট্রিক ডিভাইস নিয়ে কেন্দ্রের অভ্যন্তরে প্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বিগত প্রায় সবক’টি পরীক্ষায় বেশিরভাগ কেন্দ্রেই মোবাইল ফোন নিয়ে শিক্ষার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছে। যদিও তাদের একটি অংশ প্রশাসনের হাতে আটক হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, কেন্দ্রে প্রবেশের সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে চেক করা হলেও তারা কীভাবে মোবাইল ফোন কিংবা ইলেকট্রিক ডিভাইস নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে? সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসা, সেক্ষেত্রে কি জালিয়াত চক্র কেন্দ্রসংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে ভেতরে ফোন নেয়ার ব্যবস্থা করছে; নাকি প্রবেশের সময় গুরুত্ব সহকারে চেক করা হচ্ছে না? শুক্রবারের পরীক্ষায় আটক ৭ জনের পাঁচজনের কাছে মোবাইল ফোন এবং অন্য দুইজনের কাছ ডিভাইস পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে চেকিংয়ের মূল দায়িত্বে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে অন্য কেন্দ্রগুলোয় প্রশ্ন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তারা বেশিরভাগ সময়েই অবহেলা করে দেরিতে কেন্দ্রে পৌঁছান। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাইরের কেন্দ্রগুলোয় দেরি করে পৌঁছানোও প্রশ্ন ফাঁসের অন্যতম কারণ হতে পারে বলে মনে করেন ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর।
ভ্রাম্যমাণ আদলত কাজ না করায় অসন্তোষ : গত বছর থেকে পরীক্ষাগুলোয় জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষা আইন ১৯৮০ সালের ৯(খ) ধারায় সাজা প্রদান করা হয়। সর্বশেষ ক-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় এ আইনের আওতায় ১৩ জনকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াত চক্রের সদস্যদের সাজা প্রদানে অস্বীকৃতি জানান ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ কাজ করছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এম আমজাদ আলী যুগান্তরকে বলেন, এর আগে যেসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেসময় ভ্রাম্যমাণ আদালত জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিচার করেছেন, শাস্তি দিয়েছেন। তবে এবার (ঘ-ইউনিট) ম্যাজিস্ট্রেট এসেও চলে গেছেন। জানিনা কোন কারণে তারা বিচার করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তারা যদি সহযোগিতা না করেন তাহলে তো আমরা অসহায় হয়ে যাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন যেভাবে ফাঁস হয়
